থিয়েটার ওয়ারফেয়ার (Theatre Warfare)— অনিরুদ্ধ গুপ্ত (Aniruddha Gupta)

এই লেখাটি উপরিউক্ত বিষয় সংক্রান্ত একটি আলোচনা মাত্র, নিতান্তই ইনফরম্যাল একটি একপাক্ষিক আলোচনা বলা যেতে পারে। আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ‘যুদ্ধ’ এবং ‘বিপ্লব’ এই দুটি কথা কি প্রকৃতই সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে? আশেপাশের আয়োজন এবং মানুষের উগ্রবাদী উৎসাহ-উদ্দীপনার নিদর্শন দেখে সেই ধারণা মনে মনে ঠাওর করে নেওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। অর্থাৎ বলা যেতে পারে আজকের পরিস্থিতিতে ‘বিপ্লব’ অর্থাৎ ‘কোনো এক পরিবর্তনশীল সমাজের প্রতিষ্ঠার নিরন্তর প্রচেষ্টা’, যুদ্ধ ব্যতীত সম্ভব নয়। এখানে বলে রাখা ভালো ‘পরিবর্তনশীল সমাজ’ অর্থাৎ একটি Adaptive system ই আমাদের কাম্য হওয়া উচিত কারণ পরিবর্তন বারবার একটি সমাজে কাঙ্ক্ষিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। এবার আসা যাক যুদ্ধের প্রসঙ্গে। যুদ্ধ বলতে যে কেবলই গোলাবারুদের লড়াই এমনটা ভাবার কারণ নেই; জোরপূর্বক অথবা বলপূর্বক নিজের মত এবং ন্যায্যতা আরেকটি মানুষকে বোঝানোর জন্য তার মত এবং ন্যায্যতার সংজ্ঞাকে পরিবর্তন করার প্রচেষ্টাকে যুদ্ধ বলা যেতে পারে। অর্থাৎ পরিষ্কার হওয়া গেল আজকের দিনে প্রত্যেকটা উগ্রবাদী মানুষের কাছে ‘যুদ্ধ অনিবার্য!’

যুদ্ধ প্রসঙ্গে থিয়েটারের নাম তোলার আগে, থিয়েটারের মাধ্যমে- অর্থাৎ একটি ঘটনা অথবা একটি গল্পের অভিনয়ের মাধ্যমে, প্রতীকী থিয়েটারি মুভমেন্টের মধ্য দিয়ে, সুদৃঢ় সংলাপের মাধ্যমে যুদ্ধ-প্রচেষ্টা বা বিপ্লব-প্রচেষ্টা- এর একটা নাম দেওয়া যাক — সহজ নাম- ‘থিয়েটারি যুদ্ধ’। থিয়েটারি যুদ্ধ — এই কথাটি বর্তমান দিনে দাঁড়িয়ে শুনলে প্রথমেই যে কথাগুলি চারিদিক থেকে ভেসে আসে হাস্যধ্বনি সহকারে, তা হলো- ‘অলীক’, ‘অবাস্তব’, ‘বৃথা’, ‘সময় নষ্ট’ অথবা ব্যঙ্গার্থক ছলে প্রতিধ্বনিতে একই কথা ফিরে আসে, উচ্চারণটা খানিকটা আলাদা- “থ্যেটারি যুদ্ধ!”

তা সেই ভেসে আসা কথায় থিয়েটার কর্মীদের অথবা প্রিসাইজলি থিয়েটার-বিশ্বাসীদের বুক জুড়ে একরাশ হতাশা জমে যাওয়ার কথা, তাও তারা বারবার নাট্যাভিনয় নামক এই ‘পবিত্র শিল্প’-এ অংশগ্রহণ করে। কেন করে?

এটা আজকের দিনে কঠোর সত্যি, যে সব শিল্পী ‘স্টারকাস্ট’-এর তকমা পেয়ে উঠতে পারে না, নিজের কোনো অংশে খামতির জন্য বা অন্যান্য বিবিধ চর্চিত কারণে। আর এই স্টারকাস্ট না হয়ে উঠতে পারাটা সেই থিয়েটার শিল্পীর মতপ্রকাশের মাধ্যমের প্রসার ঘটানোতে বাঁধা সৃষ্টি করে। অনেকে এই পরিস্থিতি কে ‘এই লাইনে মার খেয়ে যাওয়া’ হিসাবে চিহ্নিত করে। এর দায় বা দোষ প্রত্যক্ষভাবে স্টারকাস্টের ওপর দেওয়া যায় না; কারণ হিসাবে আমাদের দর্শকদের বাছাই করা ‘উপভোগ্য়ের judgment’ এবং থিয়েটার যে একটা ‘easily accessible’ মাধ্যম নয় যে কেউ যেকোনো সময়ে ইচ্ছেমতো, সুবিধামতো এই শিল্পশৈলীর রস আস্বাদন করতে পারবে টিভি-মোবাইলের স্ক্রিনে — এই দুটি কারণকে মূলত দায়ী করা যেতে পারে।

তাহলে আরো এক নতুন প্রশ্নের উদ্ভব হল, থিয়েটারের কি তাহলে বিপ্লবসাধনের ক্ষমতা নেই? এখানে নিজের একটা ছোট অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ তুলছি। আমাদের নাট্যদলের একটি নাটকে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে একটি অংশ অভিনীত হয়েছিল যেটিকে অনেকাংশে ‘Direct’ বলা চলে। সেই দৃশ্যের অভিনয়ও সঠিক দক্ষতার সাথে হয়েছিল, নাটকশেষে প্রশংসিতও হয়েছিল। কিন্তু নাটকের শেষে আমার বেশ অনেক পরিচিত দর্শকই আমায় বলেছিলেন “এই ধরণের কাজ করছিস, কথা বলছিস, এটা Risk এর ব্যাপার, দিনকাল খারাপ” ইত্যাদি। সেদিন একটা স্পষ্ট হয়েছিল, কিছু মানুষ তো রেগে যায় নিশ্চয়ই, এবং সামান্য কিছু মানুষ, সে একজনও যদি হয়, তার উপলব্ধি হয়। সে বোঝে যে, স্টারকাস্ট তকমা পাওয়া ছাই না পাওয়া কিছু অনেস্ট শিল্পী তাদের সম্পূর্ণ দক্ষতার সাথে, একটি ভুলেরও অবকাশ না রেখে, মঞ্চে কোন এক বিপ্লবের ঘোষণা করে। তারপর প্রসেনিয়াম এর গন্ডি পেরিয়ে বাদলবাবুর থার্ড থিয়েটার, ফোরথ থিয়েটার, স্ট্রিট প্লে- নাট্য-উপস্থাপনায় দর্শক এবং নাট্যকর্মীর ব্যবধান হ্রাসের, নাটকের সক্রিয়তা বৃদ্ধির প্রয়াস এবং সাথে সাথে নাট্য-উপস্থাপনার ব্যাকরণে নতুন রীতি এবং ভাবনা চিন্তার সংযোজন- উদ্দেশ্য? নাট্য-উপলব্ধি বারাতে হবে, কথাগুলো আরো ভেতর অবধি যেতে হবে, ‘বিপ্লবের বার্তা’ আর জোরালো হবে। সেখানেই থিয়েটারের সাফল্য। সেখানেই এই মাধ্যমটার প্রয়োজন তার সজীবতা, তার সততা, তার নির্ভীকতা এবং তার মর্মভেদী উপস্থাপনার জন্য। আর এই কারণেই শিল্পশৈলীর প্রদর্শনের উপরেও একটা বৃহত্তর উদ্দেশ্য নিয়ে এই একরাশ নাট্যবিশ্বাসী হতাশা, ভয়, লজ্জা ঝেড়ে ফেলে নির্ভীকভাবে থ্যেটারি যুদ্ধের আহ্বান জানায় বারবার!

এখন এই থিয়েটারদর্শনের সাথে বিপ্লবের নাম জড়িয়ে পড়ায় এর মধ্যে দায়িত্বের একটা বড় অংশ ঢুকে পড়ে। শিল্পী হিসাবে যে বিপ্লবসাধনের প্রচেষ্টা চালানো হবে সেই বিপ্লবের পেছনের যে কারণ আছে, যে দর্শন আছে, সেই দর্শনে যদি কোনো একজন মানুষও প্রভাবিত হয়, অর্থাৎ তার thought-process কে যদি influence করা যায় তাহলে বিপ্লবের প্রসার ঘটে, বিপ্লব একধাপ এগোয়। কিন্তু সেই মানুষটাকে সঠিক দর্শনটা ঠিকভাবে বোঝানো গেল কি যেটা নাটকটার উদ্দেশ্য ছিল? — দায়িত্ব। বিপ্লবের পরবর্তী পর্যায়গুলি সুসংঘটিত করার প্রয়াসে সেই মানুষটা যেন সমমতে অংশগ্রহণ করে — দায়িত্ব।

এখানে আবার স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন উঠে আসে, এই দর্শন সঠিক না বেঠিক সেটা বোঝা যাবে কিভাবে?

স্বভাবতই এর প্রথম উত্তর — ‘Relative’ ব্যাপার এটা। এখন এই Relative Study করতে গেলে অনেকগুলো বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মকেন্দ্রিক ইত্যাদি। এর মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে সুদূর ঐতিহাসিক যুগ থেকেই বা তারও পূর্বে। কিন্তু ধর্মকেন্দ্রিক –এর সাথে প্রথম দুটির সর্বাঙ্গীণ মিলন ইতিহাসে বহুবারই হয়েছে, হচ্ছে — ভয়াবহ!

এই কারণে আমরা চিরদিন দেখে এসেছি, রাজনীতি এবং নাটকের মিলন খুব ঘন ঘন হয়, প্রায় সবসময়ই! উদ্দেশ্য হিসাবে দেখা যায়, কোন এক রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রতিস্থাপন করে অন্য কোনো মতাদরশের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই।

এটা এখন একটা ‘Reflexive’ ধারণা যে বাংলা নাটকের রাজনৈতিক ভাবধারা ‘বাম থেকে অতিবাম’ –এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ মূলত এবং এই ধারণার সত্যতা যাচাই করে দেখতে গেলে ইতিবাচক ফল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী অনেক ক্ষেত্রেই! এই রাজনৈতিক ভাবধারার বিরোধিতা থেকেই যুদ্ধ-বিপ্লবের আয়োজন নাট্যমঞ্চে। কিন্তু এই দর্শন সত্যিই কি বাঞ্ছনীয়? যে রাজনীতি প্রাণ নেয়, সেটা ভুল। যে রাজনীতি ধর্মকে অস্ত্র করে, সেটা ভুল। যে রাজনীতি সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক অধিকারে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, সেটা ভুল। যে রাজনীতি অর্থনীতিকে পাতালে ডুবিয়ে দেয় সেটা ভুল এবং সেটা যে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ ক্ষমতায় থেকে করতে পারে এবং করেছে বারবার! তাই রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার বা সংকীর্ণতার পরিবর্তে রাজনৈতিক বাঃ সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার Frame of reference কে চওড়া এবং নমনীয় করতে হবে। সমকালীন কোন একটি সমস্যা বা পরিস্থিতিকে For any cross section of space, for any cross-section of population, irrespective of man-made identifiers বিচার করতে হবে। অর্থাৎ কাঠগড়ায় কেবলই মানুষ এবং সেই পরিস্থিতি, সেই সমস্যা।

চন্দ্রিলবাবু বেশ কয়েকদিন আগে একটি দারুণ কথা বলেছিলেন,”আপনাদের এটা অবাক লাগে না যে আমাদের এই ভারতীয় গণতন্ত্রে একজন সাধারন মানুষ, একজন গড় ভোটার এবং একজন গড় ভোটপ্রার্থী মানে একজন নেতা, এদের সম্পর্কটা মূলত অশ্রদ্ধার?”

সত্যিই তো, রাজনীতির মঞ্চে লড়াকু সমস্ত পার্টিগুলোর নিষ্ক্রিয়তা এবং মানসিকতার সংকীর্ণতার কারণে আমাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পদ্ধতিটা Best amongst the non-eligible এর বিচারে পরিণত হয়েছে। কাজেই কোনো এক রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীর ভুল কাজ শোনা বা পড়া আমাদের রোজনামচার একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ‘জানা কথা’ তে পরিণত হয়েছে। তা বলে কি প্রতিবাদ হচ্ছে না? একঢল মানুষ ফেসবুক বা হোয়াটস্যাপে গ্রুপ খুলে অন্য একদল মানুষের প্রতি বিদ্বেষবাক্য নিক্ষেপ করে যাচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে- এটা কোনো প্রতিবাদ নয়, বরং গণতন্ত্রের পক্ষে একটা হানিকারক চর্চা।

এই প্রতিবাদের মাধ্যম হিসাবে থিয়েটারের কথা ভাবতে গেলে সেখানেও ঋণাত্মক আবহ তৈরী হবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই। মূল কারণ ঐ একই, মাধ্যমটি সহজলভ্য নয়। থিয়েটার এবং Activism কে হাতে হাত রেখে কাজে নামতে হবে। থিয়েটারের সজীবতা এবং প্রত্যক্ষচেতনাকে কাজে লাগিয়ে মাধ্যমটিকে করে তুলতে হবে সহজলভ্য। Performane space এর তোয়াক্কা একেবারেই না করে, যে কোনো জায়গায় “যুদ্ধের আহ্বান” জানাতে হবে। থিয়েটার অনুরাগীদের সংখ্যা এখন কম নয় ঠিকই, কিন্তু খুব বেশীও নয় আজকের দিনে। তাই Performance space এ ছুঁড়ে দেওয়া কথাগুলো যেন শুধু থিয়েটার অনুরাগীদের নয়, পথচলতি মানুষের, যারা performance এর প্রথমবার সাক্ষী হচ্ছেন তাদের জান ফুঁড়ে যেন কথাগুলো প্রবেশ করে। তারপর তারা তালে তাল মেলাক, প্রশংসা করুক, অথবা হয়ে কাঁচা গালাগালিও দিক, ‘যুদ্ধঘোষণা’র কাজে সার্থকতার বার্তাবহ সেটা।

Judy Chicago নামে এক মার্কিন শিল্পী বলেছিলেন, “Performance can be fulled by rage in a way a painting or a sculptor cannot”- এই rage সম্মিলিত কন্ঠে মানুষের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার পথে বাধা সৃষ্টিকারী যেকোনো বিষয়ের বিরুদ্ধে বিল্পবের বাজনা বাজাতে পারে। হয়তো সবসময় উপচে পড়া মানুষের ভিড় এহেন শৈল্পিক বিপ্লবের সাক্ষী হয়ে রাতারাতি সমাধানের পর সমাধান করে ফেলবে না, কিন্তু এহেন Activism এর এবং প্রতিবাদীদের সত্যতা বুকে বহুদিন ধরে আগুন জ্বালিয়ে রাখবে প্রত্যক্ষদর্শীর।

“যে পিতা সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে ভয় পায়

আমি তাকে ঘৃণা করি।

যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে

আমি তাকে ঘৃণা করি –

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্যপথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না-

আমি তাকে ঘৃণা করি।“

বেঁচে থাকুক নবারুণবাবুর কথাগুলি এবং বেঁচে থাকুক ‘থিয়েটারি যুদ্ধ’! বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!

--

--

Bimoorto (বিমূর্ত) : A Peforming Arts Group

Bimoorto is a performing arts group based in Kolkata, founded in the year 2017 with like-minded theatre enthusiasts from several regions of West Bengal.