পথনাটক - উদ্ভব এবং বিবর্তন (Street Theatre-Origin and Evolution)— Sudipta Banerjee

এই আর্টিকেলটি পড়ার আগে জুলিয়াস সিজার নাটকের একটি দৃশ্য মনে করা যাক। জুলিয়াস সিজার নিহত হয়েছেন। ব্রুটাস তাকে হত্যা করার পর রোমান দের কাছে এসেছে জবাব দিতে, রোমানরা ব্রুটাসের মুখ থেকে শুনছে যে কেন সিজারের মৃত্যু প্রয়োজনীয় ছিল। এবার দৃশ্য বদলে গেল, দেখা গেল মার্ক অ্যান্টনিকে, এরপরেই আমরা জানি এন্টোনির সেই সম্বোধন,

Friends, Romans, countrymen, lend me your ears;

I come to bury Caesar, not to praise him.

মুহূর্তের মধ্যে চারপাশের কোলাহল থেমে যায়। রোমানরা তখন অ্যান্টনির কথা শুনছে।

মনে করুন, আপনি একজন রোমান এবং হাজরা মোড়ে আপনার সাথে এরকম আরো কিছু রোমান আছে। এক্ষেত্রে কেবল একজন অ্যান্টনি নয়, আরো কিছু অ্যান্টনি আপনার মনের মধ্যে একটা চেতনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।

শহরে বড় রাস্তার ওপরে হোক অথবা গ্রামে-গঞ্জে, মানুষকে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে সচেতন করে তোলার এবং তাদের মুখে প্রতিবাদের ভাষা জোগানোর জন্য শিল্পের অন্যতম একটি মাধ্যম হলো স্ট্রিট থিয়েটার। ইতিহাস ঘাঁটলে বোঝা যাবে সমাজে স্ট্রিট থিয়েটারের বা পথনাটকের গুরুত্ব।

পথনাটক মানুষের নাটক, সর্বস্তরের দর্শকের জন্য এই নাটক। শিল্পীর সাথে জনতার এক যোগাযোগ সৃষ্টি হয়, এবং জনতাও সেই নাটকের একটা অংশ হয়ে উঠতে শুরু করে। স্ট্রিট থিয়েটার দেখার জন্য কোনো পথচলতি মানুষ প্রস্তুত নাও থাকতে পারেন অথবা তার হাতে বেশি সময় নাও থাকতে পারে। এই সীমাবদ্ধতা গুলোই নির্ধারণ করে পথনাটকের প্যারামিটার। পথনাটক বিশেষত ছোট হয়, এবং তার সংলাপ হতে হয় প্রত্যক্ষ, অন্তরঙ্গ এবং আরো কার্যকর হতে সাধারণত উচ্চস্বরে হয়। ভিড় টানতে ঘনঘন ব্যবহৃত হয় গান অথবা কবিতা। যথেষ্ট মুভমেন্টেরও প্রয়োজনীয়তা থাকে।

ভারতবর্ষের থিয়েটারে পথনাটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচায়ক সফদার হাশমির মতে, আমরা যেই আধুনিক পথনাটক চর্চা করি, তার উদ্ভব বিশ শতকের শুরুর দিকে, বিশেষত 1917 সালের রুশ বিপ্লবের অব্যবহতির পরে। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক শোষণে জর্জরিত শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিবাদের এক শিল্পিত ধরণ হিসাবে এর উৎপত্তি।

অক্টোবর বিপ্লবের প্রথম বর্ষপূর্তিতে ভাসভলোদ মায়ারহোল্ড মায়াকভস্কির মিস্ট্রিয়াক নাটকটির সঙ্গে বিপ্লবের কবিতা এবং সার্কাসের টেন্ট শোএর উপাদান মিশিয়ে বেশ কয়েক হাজার দর্শকের সামনে মস্কোর রেড স্কোয়ারে অভিনয় করেছিলেন এবং এই ধরণের নাট্যাভিনয় ‘agitprop’ অর্থাৎ agitational propaganda হিসাবে জনপ্রিয়তা পায়। আবার, দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় জাপান যখন চীন কে আক্রমণ করে, সেইসময়, চীনা লালফৌজের সাথে হাত মিলিয়ে চাইনিজ পিপিলস থিয়েটার গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে যারা মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছিল, রেড আর্মির পাশে দাঁড়াতে।

পথনাটকের ইতিহাসের সাথে সংগ্রাম, প্রতিবাদ, অধিকারের জন্য লড়াই জড়িয়ে আছে। শোষিত হতে হতে যখনই মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, তারা রাস্তায় নেমে এসেছে, রুখে দাঁড়িয়েছে।

ইতিহাস থেকে একটু সরে এসে আমরা যদি বর্তমান সময় দেখি, তালে পথনাটকের বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। LGBTQ+ কমিউনিটি বা ইকোলজি স্ট্রিট থিয়েটারের বিষয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, কাস্ট সিস্টেম এগুলো নিয়ে কাজ আর বেশি করে হচ্ছে।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্ট্রিট থিয়েটারের প্রধানত সূচনা ঘটে চল্লিশের দশকে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের আদর্শ এবং রাজনৈতিক থিয়েটারের হাত ধরে। 1944 সালে, Indian People’s Theatre Association (IPTA) প্রথম পথনাটক করে নবান্ন, যা ছিল বিজন ভট্টাচার্য এর লেখা 1943 সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, স্ট্রিট থিয়েটারের আলাদা গুরুত্ব কি এবং কেন এই নাটকগুলো স্টেজে মঞ্চস্থ করা হলো না। তৎকালীন শিল্পী যারা সমাজে পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখতেন তারা চেয়েছিলেন মানুষের সাথে সরাসরি সংযোগ তৈরি করতে। বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে টিকিট কেটে নাটক দেখা সম্ভব হতো না অথচ স্ট্রিট থিয়েটারের মূল লক্ষই ছিল গরিব মানুষের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি। সেইসময় পথনাটক গুলোর বিষয় গুলো হত দুর্ভিক্ষ, জাতপাত, শ্রেণিবিভেদ, সাম্প্রদায়িক হিংসা, সামন্ততান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ।

বাংলার ইতিহাস দেখতে গেলে, দেখা যায়, স্বাধীনতার পর যখন সাধারন নির্বাচন হয়, সেই সময় পানু পাল লেখেন ভেটের ভেট। এই নাটকটির মূল উদ্দেশ্য ছিল, খেটে খাওয়া কৃষকদের প্রতি জাতীয় কংগ্রেসের প্রবঞ্চনা কে তুলে ধরা এবং এই নাটকটি থেকেই বাংলা পথনাটকের প্রথম যাত্রা শুরু হয়। পথনাটক যে সাধারণ মানুষ কে কি ভীষণভাবে উৎসাহিত করে, ইতিহাস তার সাক্ষী দেয়। উৎপল দত্ত, তার পথনাটক দিন বদলের পালা, চক্রান্ত, কালোহাত, মুমুর্ষ নগরী প্রভৃতি পথনাটকের মাধ্যমে শাসক শ্রেণীর ব্যর্থতা ও ধাপ্পাবাজিকে তুলে ধরে তাদের স্বরূপ জনতার সামনে আনতেন এবং জনতাকে উত্তেজিত করতেন। ফলে ভোটবাক্স এ তার প্রভাব পড়তো।

সময়কাল আরো এগিয়ে আনলে ভারতীয় পথনাটকের তথা জনজীবনের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা টাইমফ্রেম পাওয়া যায়। সফদার হাশমি ছিলেন জন নাট্যমঞ্চের সহ প্রতিষ্ঠাতা,যা Communist Party of India র সাথে যুক্ত ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ উঠলে, সফদার হাশমি কুরসী, কুরসী, কুরসী নামক একটি পথনাটক করেন। 1977 সালে জরুরি অবস্থা শেষ হলে হাশমি তার রাজনৈতিক সক্রিয়তার ফিরে আসেন এবং ছোট কৃষকদের ওপর শোষণের বিরুদ্ধে গাও সে শহর তাক, বেকারত্ব নিয়ে কিশোর কোটি, নারীর বিরুদ্ধে অত্যাচার নিয়ে ঔরত এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে ডিটিসি কি ধাধলি প্রভূত পথনাটক গুলি করেন। হাশমি স্ট্রিট থিয়েটার কে “A militant political theatre of protest whose function is to agitate the people and to mobilize them behind fighting organizations” বলে সংজ্ঞায়িত করেন।

প্রসেনিয়াম ও পথনাটকের দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা শোনা যায় বিস্তর। আমি মনে করি, প্রসেনিয়াম একটা নিৰ্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের জন্য। যারা স্টেজের ওপর তিন দিক বন্ধ করে নাটক করছেন, সামনে থাকা অডিয়েন্সের পুরোটা দায়ে দায়িত্ব তারা নেয়না। মঞ্চের ওপর আলো, সেটের ব্যবহারের জন্য শিল্পের ডিফিকালটির মাত্রা হয়তো হ্রাস পায়। অথচ একটা বড় রাস্তার ওপর যেই দলটা স্ট্রিট প্লে করবে বলে ভেবেছে, তারা আদৌ জানেনা কটা মানুষ তাদের নাটক টি দেখবেন। বাসের, ট্রামের আওয়াজ, রাস্তার কোলাহলের মধ্যে দিয়েই তারা মানুষকে আহ্বান জানায়। এই কারণেই বেশিরভাগ স্ট্রিট প্লে শুরু হয় গান দিয়ে। প্রতিটা মুহূর্তে দর্শকের সাথে যোগাযোগ, দর্শককে নিজেদের বক্তব্য বুঝিয়ে তোলা, চিৎকার করে সংলাপ বলা এবং নিজেরাই নিজেদের শরীরের দক্ষ মুভমেন্টের মাধ্যমে সেট তৈরি করছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পথনাটক- এই ভাবনাটির সাথে শিল্প ও রাজনীতি কতটা অনুপাতে জড়িয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে প্রশ্নঃ এসেছে যে পথনাটক যদি শুধু একটা রাজনৈতিক বা সামাজিক আঙ্গিকের মধ্যে আবদ্ধ থাকে, সেক্ষেত্রে একটা আর্ট ফর্ম হিসাবে তার সার্থকতা কোথায়। আমি মনে করি পথনাটকের উদ্দেশ্য যদি একটি রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা হয়, তার সেই উদ্দেশ্য কে সার্থক করে তুলবে পথনাটকের শিল্পের দক্ষতা। শিল্প বলতে অবশ্যই এখানে অভিনয় দক্ষতা, থেকে শুরু করে তার গান, কবিতা, সংলাপ অর্থাৎ মানুষের মনে প্রভাব ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় প্যারামিটার গুলোর কথা বলা হয়েছে।

ইতিহাস লড়াইয়ের কথা বললেও, পথনাটকের সীমাবদ্ধতাও কিছুই থেকে যায়। যেমন, বর্তমানে পথনাটকের দর্শক কারা? কোথাও গিয়ে কি সেই হাজার হাজার স্বতঃস্ফূর্ত জনতার কলোরল হারিয়ে গেল? খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষক-আমজনতার পরিবর্তর কিছু বাধা দর্শকই দেখা গেল খোঁজখবর নিয়ে পথনাটকের আসরে হাজির হন। আর যদিও বা সহর্বস্তরের মানুষ এসে জড়ো হয়, সেক্ষেত্রে প্রশ্নঃ ওঠে, এরা কতটা একটা পথনাটকের অঙ্গ হয়ে ওঠে অথবা কতটা তারা সেই নাটকটির সাথে সামিল হন।

এরকম আরো অনেক প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েও স্ট্রিট থিয়েটার কিন্তু থেমে থাকেনি, সমালোচিত হয়েছে বা তার জনপ্রিয়তা কিছুটা হারিয়েছে, কিন্তু আমি বা অনেকের বিশ্বাস আজকের পথনাটক আবার ঘুরে দাঁড়াবে। পথনাটক কে কোন শৃঙ্খলে বাধা যায়না, চলমানতাই তার লক্ষণ। দেশ সীমানার গন্ডি পেরিয়ে পথনাটক ছড়িয়ে পড়বে, কারণ মানুষের নিজেদের ন্যায্য অধিকারের জন্য যে লড়াই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটা শোষিত শ্রেণীর রুখে দাঁড়ানোর যেই লড়াই, বা বহুযুগ ধরে চলে আসা কোনো বস্তাপচা ধারণা ভেঙে ফেলার জন্য যেই লড়াই, পৃথিবীর সব দেশেই তার ভাষা সমান। শিল্প বেঁচে থাকুক, সংগ্রাম বেঁচে থাকুক আর সমগরিমায় বাঁচুক পথনাটক!

Reference :

  1. https://www.academia.edu/5275829/Evolution_of_Street_Theatre
  2. https://countercurrents.org/2019/08/history-of-street-plays-in-india-an-ongoing-social-movement/
  3. “মলয় রক্ষিতের বাংলা থিয়েটার অন্য ইতিহাস”

--

--

Bimoorto (বিমূর্ত) : A Peforming Arts Group

Bimoorto is a performing arts group based in Kolkata, founded in the year 2017 with like-minded theatre enthusiasts from several regions of West Bengal.